দিন যত উন্নতির ট্র্য্যাক ধরে ছুটছে, ততই পাল্টে পাল্টে যাচ্ছে চারিপাশের চেনা ছবি। সে ছবি মানুষের মুখ, ভাষা, পোষাক, আচার-ব্যবহার, ভাবনা-চিন্তার এক একটা কোলাজ। আমাদের চিরচেনা সাদা থান ধুতি, মাথায় বড়িখোঁপা বাঁধা ভুতোর মা, কলতলায় ছাইগাদায় বসে একপাঁজা বাসন মাজতে মাজতে কবে যে নিজের ভোল পাল্টে ফেলল বুঝতেই পারলুম না।
বাজারের থলি হাতে খিড়কিগেট ঠেলে ঢুকতে গিয়ে থমকে দাঁড়ালুম। বড়িখোঁপার পাশে গোঁজা জবা ফুল। পরনের ধুতিটা ‘ওয়াশিং পাওডার নিরমা’ বলে দাঁত কেলাচ্ছে। কলতলার বেঁটে পাঁচিলে এক ঠ্যাং তুলে মহানন্দে বাতচিতে ব্যস্ত ভূতোর মা চকচকে মোবাইলে কান চেপে।
ওঃ, বাসি বাসনে হাতও পড়েনি দেখছি। ‘এহম্…’ বাধ্য হয়ে গলা খাঁকড়ালুম। পেছন ফিরে আমাকে দেখে এক চোখ মটকে হাসা হল। তারপর হাত দেখিয়ে ইশারায় চুপ করতে বলা হল। আমি স্তম্ভিত। কি যেন সেই নট নড়ন চড়ন অথচ পালাতে পারলে বাঁচি-র একটা সাজুগুজু সংস্কৃত ভাষায় ভাবনা আছে! ও, হ্যাঁ, ন যযৌ ন তস্থৌ ভাব।
অগত্যা মিনিট দুয়েক কচুর লতি, লাউ ডগা, আধ কিলো পটল, গোটা দুই ঝিঙে, এক কিলো আলু, পাঁচশো কাঁটাপোনা, ডিমের আহ্লাদী হয়ে আলতো বসানো প্যাকেট আর এক কিলো মুরগীর মুটে বাহক হয়ে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে তার তামাশাভরা মুখের বেয়াদপি দেখতে লাগলুম।
দু মিনিট যখন সহ্যের অতীত বোধ হতে লাগল, মনের বুড়ি মা বোমা ফাটব-ফাটব করছে, ভূতোর মা ফোন বন্ধ করে খুব যত্নে পশ্চাদ্দেশে ঘষে ঘষে পরিষ্কার করে ট্যাঁকে গুঁজে থেবড়ে বসলো বাসনগুলো নিয়ে। কৈফিয়ৎ চাইব কি! নিজেই শুরু করলে – ‘আর বলুনি বৌদি! আজ দুদিন ধরে গবাদা এ্যায়সান বিরক্ত করতেচে। যখুন তখুন শুদু এক বায়না – বুকে আয়! বুকে আয়!’
আমি রীতিমত থতমত। তোতলে বললুম, ‘বুকে আয় ম..মানে?’
হাতে ছাইদানীর ছোবড়া পাকিয়ে মাজা দুলিয়ে কড়াই ঘষতে ঘষতে ভূতোর মা হাসে। – ‘ঐ যে গো কি বুক হয়েচে আজকাল! ভূতোও বলে ঐখেনে থাকলি লোকের সঙে ভালো যোগাগোগ হয়। তা জোর করে মোরে বুকে এনে দিলো। আমি কি জানি ছাই! গবাদা রোজ মোরে বলতি থাকে, — ভূতোর মা, জেবন তো এক্টাই। তোর সোয়ামি পড়ি আচে সেই কোন বিদেশে। পয়সার কমতি নাই। কিন্তুক জেবনটা খাঁ খাঁ। বুকে থাক। দেখতি পাবি কতোজন তোরে আপনাইছে। ভালোবাসতিছে।’
মুটে হয়ে দাঁড়ানো যাচ্ছে না জাস্ট আর! হে ধরণী, দ্বিধা হবে কি হবে না! শেষ পর্য্যন্ত ভূতোর মার মুখে এইসব?
গম্ভীর হয়ে বললুম, ‘দ্যাখো ভূতোর মা, তোমার সোয়া- স্যরি, স্বামী আবুধাবিতে কাজ করে কন্স্ট্রাকশন ডিপার্টমেণ্টে – মানে লেবারার, মানে মজদুর হয়ে। সে তো তোমাদের সুখ স্বাচ্ছন্দের জন্যই, না কি! আর তুমি, তার প্রতি সৎ না থেকে এই বয়সে এসে ‘বুকে থাক বুকে থাক’ করছো! এ সব কি ভালো?’
‘এক মিনিট! এক মিনিট!’ সরু হয়ে পড়া কলের জলে হাত ধুয়ে কোমরের পৈঠায় হাত মুছে উঠে আসে ভূতোর মা। ‘তুমি ভাবতেছোটা কী বৌদি! অ্যাঁ!’
‘কী ভাববো!’ ঘাবড়ে বলি।
‘আরে, দুর বিদেশে পড়ি আচে যে মানুষটা তার জন্যিই তো বুকে আসলাম!’ হাত নেড়ে বলে ভূতোর মা। ‘এই দেকো,’ বলে ফোন খুলে বুড়ো আঙুলের এক ঘষায় দেখি ফেসবুকের মুখে চিচিং ফাঁক করে একে একে বের করে আনছে তার পরম যত্নে রক্ষিত ধনদৌলত।
কোলকাতা থেকে কোন সুদূর ঊষর রুক্ষ আবুধাবির ধূ ধূ মরুতে রাস্তা তৈরীর কাজে ব্যস্ত ভূতোর বাপ তার সঙ্গীঁ সাথীদের সাথে দাঁড়ানো এক গাল হাসি নিয়ে। ভূতোর বাপ এয়ারপোর্টে গত পূজায় বাড়ি আসার সময়, ভূতোর বাপ কলোনীর ঝুপড়িতে একথালা সুক্তোভাত সাবড়াচ্ছে মুখে ‘সব পেয়েছির’ হাসি নিয়ে।
সম্বিৎ ফিরলো ভূতোর মার কথার তোড়ে। ‘বৌদি গো, ভূতোর বাপকে দেকবো বলিই তো এই বুক খুলিচি। দূরে পড়ি থাকা মানুষডা আর দূরে নাই কো! এই বুকের দৌলতে সে এক্কেরে মোর বুকের মাইঝখানটিতেই আচে মনে লয়।’
ভূতোর মা পরম যত্নে ফের ট্যাঁকে ফোনখানা গুঁজে ফিরে যায় তার ছাইগাদায়। মুখে অমল হাসি। অষ্টমশ্রেণী পর্য্যন্ত পড়া বিদ্যা তার সার্থক। আমি মুটে হয়ে নীরবে ঢুকি রান্নাঘরে। মাছ মাংস জিপ্ লকে ভরে ডীপ ফ্রিজে রাখি। সবজিগুলো ধুয়ে ধুয়ে রাখি জল ঝরাতে। হঠাং কোত্থেকে রবি ঠাকুর মনের দরজায় এসে গোঁত্তা মারেন। দরজা খুলে দেখি লিখে রেখে গেছেন — ‘আমার পথে পথে পাথর ছড়ানো, তাই তো তোমার বাণী বাজে ঝর্ণা ঝরানো।’
পালটে যাক সমাজ, উলটে যাক রীতি রেওয়াজ — শুধু যেন আলো হয়ে থাকে মানুষের বুকের সরলতাটুকু। সেই সরলতার শুদ্ধ আলোকে ভূতোর মা-রা নতুন করে বাঁচুক তাদের জন্য নব্য আবিষ্কৃত জগতে। যে জগতের রং ঢং দেখে মনে হয়, ‘সত্য সেলুকাস! কি বিচিত্র এই দেশ।’
আবার তার সাথে সাথে মনের পাতায় ভেসে ওঠে — অতীত নয়। ভবিষ্যৎও নয়। একমাত্র সত্য এই ক্ষণ।
ঋদ্ধ করো অভিজ্ঞ করো, সুখী করো তাকে।
জীবনের বীক্ষা আর দীক্ষা মন্ত্র দিয়ে।
করো লালন মারশুমী ফুলের মতন অনুভূতিগুলো।
(Photo by Onkarphoto on Unsplash)
Write a comment ...